-->

রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা

 

রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা

‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের নামকরণ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় এই নামের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মনে হয় কোন গূঢ়ার্থকে প্রকাশ করতে চাননি ।

ঘর এবং বাইরের কিছু সমস্যা এই উপন্যাসে উল্লেখিত হয়েছে। বিমলা এবং নিখিলেশের তো একটিই ঘর। তবুও মনে হয় দু'জনার ক্ষেত্রে ঘরের তাৎপর্য দু'রকম। রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসে তেমনটিই যেন বলতে চেয়েছেন।

নিখিলেশ বিমলাকে সংস্কারমুক্ত করে বাইরের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে নিজের প্রেমকে যাচাই করতে। নিখিলেশ বিমলাকে বলেছে সত্যের আলোতে সমস্ত কিছুকে দেখতে। সংস্কারের অন্ধ আনুগত্যকে পরিত্যাগ করার কথা নিখিলেশ বিমলাকে বলেছে । নিখিলেশের ঘর তাই আনুগত্যের ঘর নয়। সংস্কারের ঘর নয়। নিখিলেশ চেয়েছে বিমলার ঘর প্রতিষ্ঠিত হোক সেখানে। বিমলাও ঘরের মধ্যে থেকে নিখিলেশের এই ইচ্ছাকে জানে । বাইরের জগতে পা বাড়াবার কোন বাধাই তাই থাকে না বিমলার।

অবশেষে সন্দীপের আগমনের পর বিমলার সুযোগ আসে বাইরের জগৎকে দেখার বাইরের জগতে পা ফেলার। সন্দীপের মোহে পড়ে বিমলার কাছে ঘর হয়ে গেল তুচ্ছ। নিখিলেশের প্রতি তার ভালোবাসার তীব্রতা ক্রমে কমতে থাকে। যে স্বামীর ছবিতে প্রতিদিন ফুল রেখে বিমলা স্বামীপ্রেমের প্রতি ভালোবাসা এবং নিষ্ঠাকে জানান দিত, ক্রমে পতিভক্তির কথা তার মন থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। ঘরের প্রতি কর্তব্য তার কমতে থাকে। ঘরের টান বিমলার কাছে কমতে থাকে। নিখিলেশ তা বুঝতে পারে। নিখিলেশের কাছে বিমলার এই আচরণ ঘরকে বিবর্ণ করে দেয়। নিখিলেশের মনোহরণের জন্য বিমলা স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য স্বামীর পছন্দের খোঁপা বেঁধে নিখিলেশের কাছে যায়। নিখিলেশ জবাব দেয়—“তোমাকে ছুটি দিলুম।

বিমলা এবং নিখিলেশের মনের ঘর ভেঙে যায়। বিমলা তার শয়নকক্ষে ঢুকে দেখে— “শুধু আসবাব, শুধু আলনা, শুধু আয়না, শুধু খাট, এর উপরে সেই সর্বব্যাপী হৃদয়টি নেই। রয়েছে ছুটি, কেবল ছুটি, একটা ফাঁক। ঝরণা একেবারে শুকিয়ে গেল, পাথর আর নুড়িগুলো বেরিয়ে পড়েছে। আদর নেই, আসবাব।

‘ঘরে বাইরেউপন্যাসে ঘরের এই বিপর্যয়ের কথা বলা হয়েছে। নিখিলেশ ও বিনলার অন্তর্জীবনের বিবর্তনকে এই ঘরের অংশে প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছে। ‘ঘরে বাইরে’ তাই একটি প্রতীক।

বাইরের নানা সমস্যাও এই উপন্যাসে আঁকা হয়েছে। চন্দ্রনাথবাবুর চরিত্রটি দেশভক্তির আদর্শ হওয়া প্রয়োজন ছিল। তারও একটা আভাস রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসে রাখবার চেষ্টা করেছেন সম্ভবত। নিখিলেশের উক্তিগুলির মধ্য দিয়ে বাইরের জগতের সত্যের রূপটি ফুটে উঠেছে। নিখিলেশের কথার মধ্যে ধরা পড়েছে দেশের উন্নতি বলতে বধার্থ কী বোঝায়। দেশপ্রেম বলতে কী বোঝায়। শুধুমাত্র বিলাতি জিনিস পোড়ানোর মধ্য দিয়েই দেশসেবা হয় না। বোঝানো হয়েছে বিদেশি জিনিস আর স্বদেশি জিনিসের মূল তকাটা কোথায়। বিপ্লববাদীদের স্বার্থপরতা, ভণ্ড রাজনৈতিক মানুষদের প্রকৃত স্বরূপ কী তাও আমরা নিখিলেশের কথার মধ্যে ফুটে উঠতে দেখি। বাইরের এই বিষয়কেও রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন এই উপন্যাসে ।

ঘরে বাইরের ঘর অংশটিতে দুজন নরনারীর ভেতর মনের পরিচয়কে আঁকতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। বাইরের অংশটিতে আঁকতে চেয়েছেন দেশের প্রতি সত্যস্বরূপ আনুগত্য এবং রাজনৈতিক অবস্থার রূপ। আর এই কারণেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসের সার্থক নাম রেখেছেন ‘ঘরে বাইরে।


বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন